নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেলওয়ের একটি থানা এলাকায় চলতি বছরের ৯ মাসে ২৩০টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এদের মধ্যে ১০৬ জন মারা যায় মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেলপথ পার হওয়ার সময়। সারা দেশে রেলওয়ের থানা ২৪টি। এ তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা রেলওয়ে থানার সদ্যবিদায়ী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ।
রেলওয়ে পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শামসুদ্দিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত নয় মাসে সারা দেশে রেলপথ থেকে ৭২৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অসতকর্তা, হত্যা ও আত্মহত্যার পাশাপাশি মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেলপথ পার হওয়া এসব মৃত্যুর বড় কারণ। তবে ২৪ থানা এলাকায় শুধু মুঠোফোনের কারণে মোট মৃত্যু কত, তা জানা যায়নি।
বর্তমানে ভৈরব থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসি আবদুল মজিদ বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৪২ কিলোমিটার পথে গত সেপ্টেম্বরে এক মাসেই ট্রেন দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ২৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেলপথ পার হওয়ার সময়। আর নয় মাসে লাশ উদ্ধার হয়েছে ২৩০টি। এদের মধ্যে পাঁচজনকে হত্যার পর রেলপথে ফেলে যাওয়া হয়েছিল। অন্যদের মৃত্যু হয়েছে অসতর্কতা, আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন কারণে।
গত ১৭ মে দুপুরে রাজধানীর পূর্ব নাখালপাড়া থেকে পশ্চিম নাখালপাড়ায় যাচ্ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ওবায়দুল্লাহ। তাঁর কানে মুঠোফোন ও হাতে আইসক্রিম ছিল। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলে আশপাশের লোকজন চিৎকার করে তাঁকে সরে যেতে বলে। কিন্তু তিনি কথায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে কিছুই শুনতে পাননি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। এ কথা বলছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মোবারক হোসেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কানে মুঠোফোন থাকায় অনেক সময় দ্রুতগতির ট্রেনের শব্দ শোনা যায় না। তাই মুহূর্তেই ট্রেনে কাটা পড়ে চিরতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেকে। রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সচেতনতার অভাবে দিনে দিনে এ ঘটনা বাড়ছে। নাখালপাড়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত ওবায়দুল্লাহর বাবা ভ্যানচালক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র তিন হাজার টাকা হাতে দিয়ে তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। ঘটনার আগের দিনও ফোনে আমার সঙ্গে কথা হয়। সেদিনও বলেছিলাম, ঢাকায় গাড়ির চাপ, সাবধানে থাকবা; রাস্তায় ফোনে কথা বলবা না। কিন্তু পরদিনই ফোনে কথা বলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ল আমার ছেলে।’
গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর গণসংবর্ধনায় অংশ নিতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন ছাত্রলীগের নেতা ইসমাইল হোসেন (২৮)। সন্ধ্যার দিকে তিনি খিলক্ষেত রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, তিনি মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন ধরে হাঁটার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে এভাবে তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়াকে দুঃখজনক বলছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খান। তিনি বলেন, মানুষ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে একসঙ্গে দুটি কাজ করতে পারে না। তাই ফোনে কথা বলার সময় তার অন্য কিছু খেয়াল থাকে না। আবার তরুণদের অনেকেরই মুঠোফোনে আসক্তি রয়েছে। তাঁদের মধ্যে মুঠোফোনের ব্যবহার অপব্যবহারের পর্যায়ে চলে গেছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ট্রেনে কাটা পড়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মহাখালী রেলগেট ও খিলক্ষেত এলাকায়। এর কারণ, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় রেললাইন বাঁকা। তাই দূর থেকে ট্রেন এলে দেখা যায় না। আবার বনানী থেকে কারওয়ান বাজার এলাকার রেললাইনের পাশে গড়ে উঠেছে বস্তি। এসব এলাকায় অবৈধ ক্রসিং দুর্ঘটনার কারণ।