শিরোনাম

সাংবাদিকতার পরিচয়ে চৌরাস্তায় একটি চক্র নানা অপরাধে সক্রিয় : নেতৃত্বে শামীম ও হালিম ক্লিনিকের গেইটে তালা লাগিয়ে পালিয়েছে কর্তৃপক্ষ টঙ্গী পাইলট স্কুল এন্ড গার্লস কলেজ বৃক্ষরোপন, নামাজের ঘর ও কমনরুম উদ্বোধন গাজীপুরে একজনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড উন্মোচিত হয়নি কালীগঞ্জে সাবেক এমপি পুত্র হত্যা রহস্য গাজীপুরে পুত্র হত্যার পর বাবার আত্মহত্যা তাজউদ্দীন পুত্র সোহেল তাজের মনের শক্তি অনেক

কাপাসিয়ায় ঘুমন্ত মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা

নিহত সূয্যি বানু ও মাফিয়া বেগম
ব্যুরো চীফ, কাপাসিয়া : গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গভীর রাতে ফের শোবার ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। দুর্ধর্ষ দুর্বৃত্তরা এবার কুপিয়ে ও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে দরিদ্র মা ও মেয়েকে হত্যা করেছে। গত সোমবার গভীর রাতে উপজেলার পাবুর গ্রামের দাইবাড়ি চৌরাস্তা সংলগ্ন জোড়া খুনের ওই ঘটনা ঘটেছে।
নিহতরা হলেন সূর্য্যি বানু (৮৫) ও তাঁর বড় মেয়ে মাফিয়া বেগম (৫৫)। নিহত সূর্য্যি বানু ওই গ্রামের মৃত মিয়ার উদ্দিনের স্ত্রী। নিহত মাফিয়া বেগম দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে স্বামী পরিত্যক্তা। তাঁর কোন সন্তানও নেই। হত্যাকান্ডের পর দুর্বৃত্তরা ট্রাঙ্ক ভেঙে সূর্য্যি বানুর চিকিৎসার জন্য রাখা ৮ হাজার টাকা ও কানের দুল লুট করেছে।
নিহতের স্বজনদের দাবি, কারো সঙ্গে তাঁদের কোন শত্রুতা ছিল না। অজ্ঞাতনামা র্দুবৃত্তরা কী কারনে কারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, তা ধারণাও করতে পারছেন না তাঁরা।
তবে গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন-অর রশিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দাবি করেন, মাদকাসক্তরাই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।
এর আগে গত ১৯ মার্চ গভীর রাতে একই উপজেলার জায়গীর মধ্যপাড়া গ্রামে শোবার ঘরে ঢুকে গণধর্ষণের পর ১১ বছর বয়সী মাহ্ফুজা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তাকে রক্ষা করতে গেলে নিহত শিশুর ফুফুকেও (২২) দুর্বৃত্তরা গণধর্ষণের পর কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এছাড়া গত প্রায় সাত মাসের ব্যবধানে কাপাসিয়ায় শিশুছাত্রীসহ চার নারীকে গভীর রাতে শোবার ঘর থেকে তুলে নিয়ে দুর্বৃত্তরা গণধর্ষণের পর হত্যা করলেও রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনিদের ধরতে পারেনি পুলিশ। এতে উপজেলাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সর্বশেষ মা-মেয়ের হত্যাকান্ডের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রহস্য উন্মোচন কিংবা খুনিদেরও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
জানা গেছে, প্রায় ১৫ বছর আগে সূর্য্যি বানুর স্বামী কৃষক মিয়ার উদ্দিন মারা যান। এরপর থেকে বার্ধক্যসহ নানা রোগে শয্যাশায়ী সূর্য্যি বানু। তাঁর তিন ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলে-মেয়েরা সবাই বিবাহিত। বড় ছেলে রুহুল আমিন ও ছোট ছেলে আনোয়ার হোসেন নিরীহ কৃষক। মেজো ছেলে মহসিন আলী দীর্ঘদিন ধরে সৌদিপ্রবাসী।
প্রতিবেশীরা জানায়, সূর্য্যি বানুর বড় মেয়ে মাফিয়া বেগমের বিয়ে হলেও স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সংসার টেকেনি। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি স্বামী পরিত্যক্তা ছিলেন। মাফিয়া তাঁর মায়ের সঙ্গে থাকতেন। দিনমজুরি করে নিজের ও শয্যাশায়ী মায়ের পেটের ভাত জুটাতেন তিনি।
স্বজনরা জানায়, সৌদিপ্রবাসী মেজো ছেলে মহসিন আলী তাঁর মা সূর্য্যি বানুর চিকিৎসাসহ পথ্য কেনার জন্য কয়েক মাস পর পর টাকা পাঠাতেন। গত এক সপ্তাহ আগেও ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে বড় ভাই রুহুল আমিনের হিসাব নম্বরে মায়ের চিকিৎসা ও ওষুধসহ পথ্য কেনার জন্য দশ হাজার টাকা পাঠান তিনি।
সূর্য্য বানুর বড় ছেলে রুহুল আমিন জানান, মেজো ভাইয়ের পাঠানো দশ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে তিনি তাঁর মায়ের হাতে দেন। দুই হাজার টাকা দিয়ে তাঁর মা ওষুধ ও কিছু ফলসহ পুষ্টিকর খাবার আনিয়ে খেয়েছেন। বাকি ৮ হাজার টাকা তাঁর মা ঘরের ভেতর ট্রাঙ্কে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন।
সূর্য্যি বানুর ছোট ছেলে আনোয়ার হোসেন জানান, গত সোমবার রাত সোয়া আটটার দিকে প্রতিদিনের মতই তাঁর মা সূর্য্যি বানু ও বড় বোন মাফিয়া রাতের খাবার খেয়ে একই ঘরে ঘুমাতে যান। রাত সাড়ে ১০টার দিকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামে। ওই সময় ঘরের বাইরে থেকে ভাতিজা হারুন-অর রশিদের সঙ্গে তাঁর মায়ের কথা হয়েছিল।
সূর্য্যি বানুর নাতি হারুন-অর রশিদ জানান, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির সময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সে ঘরের বাইরে বের হয়। ওই সময় ঘুমিয়েছেন কিনা খোঁজ নিলে তার দাদি ঘরের ভেতর থেকে সাড়াও দেন। গতকাল সকালে ঘুম থেকে জেগেও সে বাইরে থেকে তার দাদিকে ডাক দেয়। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে কোন সাড়া আসছিল না। ওই সময় দরজার খিল খোলা ছিল। বার বার ডেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় তার মা ঘরের ভেতর গিয়ে বিছানার ওপর সূর্য্যি বানুর রক্তাক্ত মরদেহ দেখতে পান। মরদেহের পাশে রক্তাক্ত নিঃসাড় দেহে গোঙাচ্ছিলেন মাফিয়া বেগম। মুমূর্ষু অবস্থায় স্বজনরা কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘মাফিয়া বেগমের মাথাসহ শরীরজুড়ে অসংখ্য ধারালো অস্ত্রের গুরুতর জখম ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মারা যান।’
মা-মেয়ের মরদেহের সুরতহালের পর কাপাসিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোমেন সিরাজী জানান, দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে সূর্য্যি বানু ও তাঁর মেয়ে মাফিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। নিহতদের মাথাসহ শরীরজুড়ে ধারালো অস্ত্রে অসংখ্য গুরুতর জখম রয়েছে।
নিহত সূর্য্যি বানুর বড় ছেলে রুহুল আমিন জানান, তাঁর মা সূর্য্যি বানু ও বোন মাফিয়া বেগম বাড়ির একটি মাটির ঘরে থাকতেন। ঘরটিতে একটি চৌকি, একটি বাঁশের তৈরি আলনা ও একটি ট্রাঙ্ক ছাড়া কোন আসবাবপত্র ছিল না। ঘটনার পর ট্রাঙ্কটি ছিল ভাঙা। তিনি অভিযোগ করেন, ট্রাঙ্কের ভেতর নগদ ৮ হাজার টাকা ও তাঁর মায়ের একজোড়া কানের দুলসহ কয়েকটি শাড়ি ছিল। হত্যাকান্ডের পর দুর্বৃত্তরা ওই টাকাসহ কানের দুল ও শাড়িগুলো লুট করে।
রুহুল আমিন আরো জানান , তারা গ্রামের দরিদ্র ও নিরীহ মানুষ। তাঁদের সঙ্গে কারো কোন শত্রুতা ছিল না। কী কারণে কারা নির্মম এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, ধারণাও করতেও পারছেন না তিনি। হত্যাকান্ডের  পরও ঘরের দরজা ও খিল অক্ষত রয়েছে। তিনি ধারণা করছেন, খুনিদের কেউ আগেই ঘরের ভেতর চৌকির নিচে লুকিয়েছিল। গভীর রাতে কোন এক সময় দরজা খোলে সহযোগীদের নিয়ে তাঁর ঘুমন্ত মা ও বোনকে কুপিয়ে ও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।
নিহত সূর্য্যি বানুর ছোট ছেলে কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, গভীর রাতে কোন এক সময় নির্মম এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকান্ড ঘটার সময় তাঁরা পাশের ঘরে ঘুমালেও টের পায়নি। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘খুনিরা ঘরের ভেতর ঢুইকা কারবালা বানাইয়া গেল, কিছুই টের পেলাম না। কি জবাব দিমু রে খোদার কাছে। কি কাল্ ঘুম আইছলরে চোখে।’
হত্যাকান্ডে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার দাবি করে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার মা-বোনের লাশ দেইখ্যা কেউ ঠিক থাকতে পারছে না। পুলিশ যেন খুনি হিংস্ত্র জানোয়ারগরে খুঁইজ্যা বাইর করে অ্যারেস্ট করে। আমি খুিনগর ফাঁসি দেখবার চাই।’
গতকাল দুপুরে গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন-অর রশিদ ও সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) কালিগঞ্জ সার্কেল শফিউর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
গতকাল সকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কাপাসিয়া থানা চত্বরে অনুষ্ঠিত পুলিশের ‘ওপেন হাউস ডে’ অনুষ্ঠানে মা-মেয়ের হত্যাকান্ডে ঘটনা প্রসঙ্গে গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন-অর রশিদ দাবি করেন, ‘মাদকাসক্তরা নির্মম এ হত্যাকান্ড টি ঘটিয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘ ট্রাঙ্ক ভেঙে টাকা চুরির সময় দেখে ফেলায় চিহ্নিত মাদকাসক্তরা কুপিয়ে সূর্য্যি বানু ও মাফিয়াকে হত্যা করে থাকতে পারে। তবে হত্যাকান্ড যে কারণেই ঘটুক, খুব দ্রুত রহস্য উন্মোচনসহ খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
মা-মেয়ের হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে কাপাসিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি) আহসান উল্লাহ্ জানান, নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য পুলিশের সর্বত চেষ্টা চলছে। তিনি দাবি করেন, ‘দু-একদিনের মধ্যে খুনিরা ধরা পড়বে।’